সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

কার্ডিনাল রিশল্যু কে ছিলেন ?

কার্ডিনাল রিশল্যু

কার্ডিনাল রিশল্যু কে ছিলেন ?


        ফ্রান্সে চতুর্থ হেনরির মৃত্যুর পর তাঁর নাবালক পুত্র ত্রয়োদশ লুই (১৬১০-৪৩ খ্রীঃ) সিংহাসনে বসেন। ত্রয়োদশ লুই নাবালক থাকায় রাজমাতা হিসেবে শাসন ভার গ্ৰহণ করে মেরি ডি মেডিচি। এই সময়ে কিশোর রাজার অনভিজ্ঞতা ও দুর্বলতার সুযোগে মেরি অবাঞ্চিত ও রাজকীয় প্রশাসনে হস্তক্ষেপ করে প্রশাসনকে দুর্বল করে দিয়েছিলেন। প্রশাসনিক ব্যবস্থা একেবারে দুর্বল হয়ে পড়েছিল। এই সংকটজনক সময়ে ত্রয়োদশ লুই কার্ডিনাল রিশল্যুকে (১৬২৪-৪২ খ্রীঃ) ফ্রান্সের প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত করেন। কিছুদিনের মধ্যেই তিনি ফ্রান্সের প্রকৃত শাসকে পরিণত হন। জন্মসূত্রে রিশল্যূ ছিলেন আভিজাত এবং পেশায় ছিলেন যাজক।

       কার্ডিনাল রিশল্যু ১৫৮৫ খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্সের সাধারণ এক অভিজাত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ধর্মযাজক হিসেবে তিনি জীবন শুরু করেন। মাত্র ২৪ বছর বয়সে তিনি লুকোন নামক একটি জেলায় চার্চের বিশপ নিযুক্ত হন। এই লুকোনের প্রতিনিধি হিসেবে তিনি ১৬১৪ খ্রিস্টাব্দে স্টেট জেনারেলের সভাই প্রতিনিধিত্ব করেন। এই সভায় রিশল্যু তার অসাধারণ প্রতিভার দ্বারা রাণী মেরি ডি মেডিচির দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। রানী মেরি তাকে রাজকীয় কাউন্সিলের একটি পদ দান করেন এবং রোমান ক্যাথলিক চার্চের কার্ডিনাল পদে নিযুক্ত করেন। রাজকীয় কাউন্সিলের সদস্য হিসেবে তিনি ক্রমে ফ্রান্সের সকল ক্ষমতার শীর্ষে নিজেকে স্থাপন করতে সক্ষম হন। তিনি প্রথমে রানী মেরি ও পরে তার পুত্র ত্রয়োদশ লুই এর মন জয় করার কাজে অগ্রসর হন। এ পর্যায়ে রাজা ত্রয়োদশ লুই রাজমাতা মেরীকে অবসরে যেতে বাধ্য করেন এবং রিশল্যুকে বরখাস্ত করেন। কিন্তু রিশল্যু নিজেকে এমন অপরিহার্য করে তুলেছিলেন যে তাকে ছাড়া রাজকার্য অচল হয়ে যাচ্ছিলো। ফলে রাজা তাকে পছন্দ না করলেও তাকে পূর্ণবহাল করতে বাধ্য হন। ১৬২৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি প্রধানমন্ত্রী হন। ১৬২৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি ছিলেন ফ্রান্সের অভ্যন্তরীণ ও পররাষ্ট্রনীতির একমাত্র নিয়ম ও নিয়ন্ত্রক।

       কার্ডিনাল রিশেল্যুর উদ্দেশ্যে ছিল দুটি,যথা– অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে ফ্রান্সের রাজশক্তি-কে সর্বময় করে গড়ে তোলা। এবং বৈদেশিক নীতিতে ইউরোপীয় রাজনীতিতে ফ্রান্সের অধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা।

      রিশল্যু ছিলেন একজন ধর্মযাজক বাস্তব জীবনে তিনি ছিলেন রাজনীতিবিদ, বাস্তবধর্মী। দেশের স্বার্থে তিনি রাজনীতিতে প্রোটেস্ট্যান্টদেরকে নিজের হাতে দমন করেন। আবার দেশের স্বার্থে বিদেশে ৩০ বছর ব্যাপি যুদ্ধে নিজে ক্যাথলিক হয়েও প্রোটেস্ট্যান্টদের পক্ষে যোগদান করেন। এজন্য বলা হয় রিশল্যু নিজ দেশে ক্যাথলিক এবং ভিনদেশে প্রোটেস্ট্যান্ট। তার প্রচেষ্টায় ১৬৪২ খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্স‌ স্পেনের চেয়ে মহাশক্তিধর সামরিক শক্তির অধিকারী হয়। তিনি অভিজাত ও হিউগেনদের  দমন করেন। তিনি ফ্রান্সের রাজতন্ত্রকে গৌরবের শিখরে প্রতিষ্ঠা করেন। পররাষ্ট্রনীতিতে তিনি যে যোগ্যতা ও কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছিলেন তার তুলনা হয় না। কূটনীতিতে তিনি ছিলেন অতিশয় চতুর । শত্রুদের মিত্রের পরিণত করতে এবং নতুন মিত্রতা স্থাপন করতে তিনি ছিলেন পন্ডিত। ১৬৪২ খ্রিস্টাব্দে রিশল্যুর মৃত্যু ঘটলে তার যোগ্য উত্তরসূরী ম্যাজারিন তার অসমাপ্তি কাজ সমাপ্ত করেন।



মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ বিষয়ে হবসন-লেনিনের তত্ত্ব আলোচনা করো।

উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ বিষয়ে হবসন-লেনিনের তত্ত্ব: ভূমিকা: আধুনিক বিশ্বের সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির উপনিবেশ প্রসারের কৌশল ‘নয়া উপনিবেশবাদ’ ও ‘নয়া সাম্রাজ্যবাদ’ নামে পরিচিত। উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক বিষয়কে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করে জে. এ. হবসন এবং ভি. আই. লেনিন সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদ সম্পর্কে তাদের অর্থনৈতিক ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন। হবসনের ব্যাখ্যা:  ব্রিটিশ অর্তনীতিবিদ জে. এ. হবসন তাঁর ‘সাম্রাজ্যবাদঃ একটি সমীক্ষা’ নামক গ্রন্থে সাম্রাজ্যবাদ ও ঔপনিবেশিকতাবাদের অর্থনৈতিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তাঁর ব্যাখ্যার প্রধান বিষয়গুলি হল—  [1] অর্থনৈতিক মুনাফা লাভ: হবসনের মতে, সাম্রাজ্যবাদের পিছনে কোনো মহৎ, বা উচ্চতর লক্ষ্য নয়, অর্থনৈতিক মুনাফাই ছিল নয়া উপনিবেশকারীদের প্রধানতম উদ্দেশ্য। পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় সমাজে ধনসম্পদ বণ্টনের ক্ষেত্রে ব্যাপক বৈষম্যের ফলে পুঁজিপতিদের হাতে যে ‘মূলধনের পাহাড়' সৃষ্টি হয়, সেই মূলধন নতুন ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করে তারা মুনাফা লাভের পরিকল্পনা করে। [2] পুঁজিপতিদের চাপ: হবসন মনে করেন যে, নতুন ক্ষেত্রে মূলধন বিনিয়োগ করা...

অবশিল্পায়ন কি ? ঔপনিবেশিক ভারতে অবশিল্পায়নের কারণ ও ফলাফল লেখো ।

অবশিল্পায়নঃ        অবশিল্পায়ন বলতে বোঝায় শিল্পায়নের বিপরীত বা শিল্পের অধোগতি। অর্থাৎ ব্রিটিশ শাসনধীন ভারতের চিরাচরিত ও ঐতিহ্যশালী হস্তশিল্প-কুটিরশিল্পের ধ্বংস সাধনই মূলত অবশিল্পায়ন। সব্যসাচী ভট্টাচার্যের মতে যদি দেশের মানুষ শিল্প-কর্ম ছেড়ে চাষ-আবাদে জীবিকা অর্জন শুরু করে অথবা জাতীয় কৃষিজ ও অংশ বাড়তে থাকে এবং শিল্পজ অংশ কমতে থাকে তাকে অব-অবশিল্পায় বলে। অবশিল্পায়নের ফলে ভারতের অর্থনৈতিক ভারসাম্য নষ্ট হয়। ব্রিটিশ শাসনকালে ভারতের অবশিল্পায়ন সম্পর্কে প্রথম পর্বে দাদাভাই নাও রোজি, রমেশ চন্দ্র দত্ত, মহাদেব গোবিন্দ রানাডে প্রমুখ জাতীয়তাবাদী নেতা এবং পরবর্তীকালে রজনীপাম দত্ত জাতীয়তাবাদী নেতা এবং পরবর্তীকালে রজনী পামদত্ত, গ্যাডগিল, বি.ডি. বসু, নরেন্দ্রকৃয় সিংহ, বিপান চন্দ্র, অমিয় বাগচি প্রমুখ ঐতিহাসিক আলোচনা করেছেন। অব-শিল্পায়নের কারণঃ (১) কাঁচামালের রপ্তানি: ভারতীয় শিল্পের ধ্বংসের সঙ্গে সঙ্গে ভারত থেকে ইংল্যান্ডে কাঁচামাল রপ্তানি শুরু হয়। ভারত ইংল্যান্ডের কলকারখানার খোলা বাজার ও কাঁচামাল সরবরাহের উৎসে পরিণত হয়। ভারত থেকে তুলো, নীল, কফি, চা, রেশম প্রভৃতি ইং...

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও। এই যুদ্ধে ভারতের ভূমিকা কী ছিল ?

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ: সূচনা: ১৯৬০-এর দশকের শেষদিকে আওয়ামি লিগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে পূর্ববঙ্গের স্বাধীনতার দাবিতে আন্দোলন শুরু হয়। ১৯৬৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে বাংলাদেশের মুক্তি আন্দোলন চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছোয়। (1) মিথ্যা মামলায় জড়ানো: শেখ মুজিবুরসহ অন্যান্য আওয়ামি লিগ নেতাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয় যে, তারা ভারতের সঙ্গে মিলে পাকিস্তানের অখণ্ডতার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। এই অভিযোগে পাক সরকার ১৯৬৮ খ্রিস্টাব্দের প্রথমদিকে শেখ মুজিবুরসহ ৩৫ জন নেতাকে গ্রেপ্তার করে মিথ্যা আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় ফাঁসিয়ে দেয়। ফলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ তীব্র হয়ে ওঠে। প্রবল আন্দোলনের চাপে পাক সরকার মামলা প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়। (2) সাধারণ নির্বাচন: পূর্ব ও পশ্চিম উভয় পাকিস্তানের সরকার- বিরোধী অসন্তোষ বাড়তে থাকলে পাকিস্তানের সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খান ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে দেশে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত করেন। এই নির্বাচনে মুজিবের নেতৃত্বাধীন আওয়ামি লিগ পূর্ব পাকিস্তানের ১৬২টি আসনের মধ্যে ১৬০টি আসন লাভ করে। পশ্চিম পাকিস্তানের ১৪০টি আসনের মধ্যে জুলফিকার আলি ভুট্টোর পিপলস পাটি ...

সুয়েজ সংকটের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও।

সুয়েজ সংকটের সংক্ষিপ্ত পরিচয়ঃ  সূচনা: মিশর দেশের উত্তর-পূর্ব দিকে ইংরেজ ও ফরাসিদের তত্ত্বাবধানে খনন করা একটি খাল হল সুয়েজ খাল। ১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে ওই খাল খনন শুরু হলেও ১৮৬৯ থেকে এতে বাণিজ্যিকভাবে জাহাজ চলাচল শুরু হয়। ইউনিভার্সাল সুয়েজ ক্যানাল কোম্পানি নামে এক সংস্থাকে একটি চুক্তির ভিত্তিতে ৯৯ বছরের জন্য খালটি পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার আগেই ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দের ২৬ জুলাই মিশরের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি গামাল আবদেল নাসের এক ঘোষণাবলে সুয়েজ খাল ও সুয়েজ ক্যানাল কোম্পানি—দুটিকেই জাতীয়করণ করে নেন। বিশ্বজুড়ে এই সমস্যাকেই সুয়েজ সংকট বোঝায়। সুয়েজ সংকটের কারণঃ (১) ব্রিটেন ও ফ্রান্সের দায়িত্ব: আরব-ইজরায়েল দ্বন্দ্ব চলাকালে ব্রিটেন ও ফ্রান্স ইজরায়েলকে অস্ত্র সরবরাহের সিদ্ধান্ত নিলে আরব দেশগুলি ক্ষুব্ধ হয় এবং নাসেরের সঙ্গেও পাশ্চাত্য দেশগুলির মনোমালিন্য শুরু হয়। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ব্রিটেন ও ফ্রান্সই সুয়েজ খালের ওপর সবথেকে বেশি নির্ভরশীল ছিল। মার্কিন বিদেশমন্ত্রী ডালেস যখন সুয়েজ খাল ব্যবহারকারী দেশগুলিকে নিয়ে এক সংস্থা গঠনের প্রস্তাব দেন তখ...

জোটনিরপেক্ষ নীতি কী ? জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের উদ্দেশ্য ও গুরুত্ব লেখো।

জোটনিরপেক্ষ নীতিঃ     দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে একদিকে সোভিয়েত রাশিয়ার নেতৃত্বে সাম্যবাদী বা সমাজতান্ত্রিক জোট, অপরদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পুঁজিবাদী বা ধনতান্ত্রিক রাষ্ট্রজোট গঠিত হয়। এই দুই জোটের কোনোটিতেই যোগ না দিয়ে, স্বাধীনভাবে উভয় জোটের সঙ্গেই বন্ধুত্ব বা সমদূরত্ব বজায় রেখে সম্পূর্ণ স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে বৈদেশিক সম্পর্ক পরিচালনার নীতি জোটনিরপেক্ষ নীতি নামে পরিচিত। জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের কারণ বা উদ্দেশ্য ঃ    মার্কিন নেতৃত্বাধীন পুঁজিবাদী জোট ও সোভিয়েত নেতৃত্বাধীন সাম্যবাদী জোটের পারস্পরিক দ্বন্দ্ব থেকে উদ্ভূত ‘ঠান্ডা লড়াই'-এর আর্বত থেকে নিজেকে দূরে রেখে, জাতীয় স্বার্থ ও নবলব্ধ স্বাধীনতাকে রক্ষার জন্য ভারত জোটনিরপেক্ষ বিদেশনীতি গ্রহণ করে। ভারতে জোটনিরপেক্ষ নীতি গ্রহণের কারণগুলি হল— [1] ভৌগোলিক সুরক্ষা : এশিয়া মহাদেশের দক্ষিণে এমন একটা জায়গায় ভারতের অবস্থান যা তাকে মধ্যপ্রাচ্য। ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে সংযোগ স্থাপনকারী দেশে পরিণত করেছে। আফগানিস্তান, পাকিস্তান, নেপাল, ভুটান, চিন, ব্রহ্মদেশ, শ্রীলঙ্কা এবং দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশি...