সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

অবশিল্পায়ন কি ? ঔপনিবেশিক ভারতে অবশিল্পায়নের কারণ ও ফলাফল লেখো ।

অবশিল্পায়নঃ

       অবশিল্পায়ন বলতে বোঝায় শিল্পায়নের বিপরীত বা শিল্পের অধোগতি। অর্থাৎ ব্রিটিশ শাসনধীন ভারতের চিরাচরিত ও ঐতিহ্যশালী হস্তশিল্প-কুটিরশিল্পের ধ্বংস সাধনই মূলত অবশিল্পায়ন। সব্যসাচী ভট্টাচার্যের মতে যদি দেশের মানুষ শিল্প-কর্ম ছেড়ে চাষ-আবাদে জীবিকা অর্জন শুরু করে অথবা জাতীয় কৃষিজ ও অংশ বাড়তে থাকে এবং শিল্পজ অংশ কমতে থাকে তাকে অব-অবশিল্পায় বলে। অবশিল্পায়নের ফলে ভারতের অর্থনৈতিক ভারসাম্য নষ্ট হয়। ব্রিটিশ শাসনকালে ভারতের অবশিল্পায়ন সম্পর্কে প্রথম পর্বে দাদাভাই নাও রোজি, রমেশ চন্দ্র দত্ত, মহাদেব গোবিন্দ রানাডে প্রমুখ জাতীয়তাবাদী নেতা এবং পরবর্তীকালে রজনীপাম দত্ত জাতীয়তাবাদী নেতা এবং পরবর্তীকালে রজনী পামদত্ত, গ্যাডগিল, বি.ডি. বসু, নরেন্দ্রকৃয় সিংহ, বিপান চন্দ্র, অমিয় বাগচি প্রমুখ ঐতিহাসিক আলোচনা করেছেন।


অব-শিল্পায়নের কারণঃ

(১) কাঁচামালের রপ্তানি: ভারতীয় শিল্পের ধ্বংসের সঙ্গে সঙ্গে ভারত থেকে ইংল্যান্ডে কাঁচামাল রপ্তানি শুরু হয়। ভারত ইংল্যান্ডের কলকারখানার খোলা বাজার ও কাঁচামাল সরবরাহের উৎসে পরিণত হয়। ভারত থেকে তুলো, নীল, কফি, চা, রেশম প্রভৃতি ইংল্যান্ডে পাঠানো হতে থাকে। এই কাঁচামাল বিলেতে শিল্পের অগ্রগতিতে সহায়তা করে। ফলে কাঁচামালের অভাবে দেশীয় শিল্পের অগ্রগতি ব্যাহত হয়।

(২) শিল্পবিপ্লব: অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগে ইংল্যান্ডে শিল্প-বিপ্লবের সূচনা হয়। যন্ত্রের সাহায্যে অনেক কম সময়ে অনেক উন্নত মানের ও সম্ভা শিল্পপণ্য, বিশেষ করে সুতিবস্ত্র ইংল্যান্ডের কলকারখানাগুলিতে তৈরি হতে থাকে। ব্রিটিশ শিল্পপতিদের চাপে সরকার ভারতের দরজা ইংল্যান্ডের বণিকদের কাছে খুলে দিতে বাধ্য হয়। ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দে আইনের মাধ্যমে কোম্পানির একচেটিয়া বাণিজ্যের অবসান ঘটলে ইংল্যান্ডের অন্য ব্যবসায়ীরা ব্যাপকহারে ভারতে আসতে থাকে। তারা এদেশে জমিজমা কিনে তাতে নীল, কফি, রবার, তামাক প্রভৃতির চাষ শুরু করে এবং কাচামাল ইংল্যান্ডে রপ্তানি করতে থাকে। ১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দে ভারতে রেলব্যবস্থা চালু হলে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ব্রিটিশ পণ্যাদির অনুপ্রবেশ ঘটে। এসব পণ্যে ভারতের বাজার ছেয়ে গেলে দেশের বাজারে দেশীয় পণ্য বিক্রি দারুণভাবে মার খায়।

(৩) সুতিবস্ত্রে শুষ্ক আরোপ: একদা ইংল্যান্ড-সহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ভারতের বস্ত্রশিল্পের ব্যাপক চাহিদা ছিল। ভারতীয় বস্ত্রের চাহিদা হ্রাস করে বিলেতি বস্ত্রের চাহিদাবৃদ্ধির উদ্দেশ্যে ব্রিটিশ সরকার ভারত থেকে ব্রিটেনে রপ্তানি করা সুতিবস্ত্রের ওপর উচ্চহারে শুল্ক চাপায়। এর ফলে ব্রিটেনে ভারতীয় সুতিবন্ধের মূল্য অস্বাভাবিক বেড়ে গেলে এর চাহিদা হ্রাস পায়।

(৪) অসম শুল্কনীতি: কোম্পানি নিজে বিভিন্ন পণ্যের ওপর শুল্ক ছাড়ের সুযোগ নিলেও ব্রিটিশ সরকার বিভিন্ন দেশীয় শিল্পপণ্যের ওপর বিশাল শুল্ক আরোপ করে।

(৫) অবাধ বাণিজ্যনীতি: ব্রিটিশ সরকার ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দের সনদ আইনের মাধ্যমে ভারতে কোম্পানির একচেটিয়া বাণিজ্যের অবসান ঘটায়। ফলে সকল ইংরেজ বণিকের জন্য ভারতের বাণিজ্যের দরজা খুলে যায় এবং দেশীয় শিল্প-বাণিজ্যে তাদের একাধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়।

(৬) নির্যাতন: ভারতীয় শিল্পী ও কারিগরদের ওপর ব্রিটিশ সরকারের নির্যাতন ও বর্ণনা দেশীয় শিল্পের যথেষ্ট ক্ষতি করে। বাংলার তাঁতিরা কীভাবে শোষিত হত তা উইলিয়াম বোল্টস্-এর রচনা থেকে জানা যায়। কোম্পানির কর্মচারী ও দালালরা তাঁতিদের অগ্রিম দাদন নিতে এবং শুধু ইংরেজ কোম্পানির জন্য সুতিবদ্ধ বুনতে বাধ্য করত। দাদন গ্রহণকারী তাঁতিরা লোকসান স্বীকার করে বাজারের চেয়ে অন্তত ২০ থেকে ৪০ শতাংশ কম দামে তাদের বস্ত্র বিক্রি করতে বাধ্য থাকত। ১৭৬৭ খ্রিস্টাব্দে ভেরেলস্ট লিখেছেন যে, বহু তাঁতি তাদের ব্যাবসা ছেড়ে দেওয়ায় ঢাকা, মুরশিদাবাদ, আগ্রা, বারাণসী, সুরাট, আমেদাবাদ প্রভৃতি শহরগুলি জনশূন্য ও শ্রীহীন হয়ে পড়ে।

(৭) মূলধনের অভাব : অষ্টাদশ শতকে ইংল্যান্ডে পর্যাপ্ত মূলধনের জোগান সেখানকার শিল্পবিপ্লবকে সহজ করে তোলে। কিন্তু এই সময় ভারতে মূলধনের যথেষ্ট অভাব ছিল। তা ছাড়া কোম্পানি দীর্ঘদিন ধরে এদেশের অর্থ সম্পদ শোষণ করে বিলেতে পাচার করলে এদেশের দারিদ্র্য আরও বৃদ্ধি পায়। ব্রিটিশ সরকার ভারতে শিল্পের বিকাশ না ঘটিয়ে ভারতকে কাঁচামাল সরবরাহকারী দেশ হিসেবে গড়ে তোলার নীতি গ্রহণ করে।

        কেবল সুতিবস্ত্রই নয়— রেশম ও পশমজাত দ্রব্য, লোহা, মৃৎশিল্প, কাচ, অস্ত্রশস্ত্র, ঢাল-তলোয়ার, খোদাই ও কারুকার্যের সঙ্গে জড়িত শিল্প প্রভৃতি দেশীয় শিল্পগুলি ধ্বংস হয়। দেশীয় শিল্পের ধ্বংসের ফলে ভারতের দারিদ্র্য আরও বৃদ্ধি পায়। শিল্প-বাণিজ্য থেকে বহু মানুষ কৃষিকাজে যোগ দিলে জমিতে চাপ পড়ে।


অব-শিল্পায়নের ফলাফলঃ

       অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগে ভারতে রাজনৈতিক অস্থিরতার সুযোগে ব্রিটিশরা এদেশে রাজনৈতিক আধিপত্য স্থাপনে সমর্থ হয়। ব্রিটিশ ভারতে অবশিল্পায়নের ফলাফল ছিল অত্যন্ত সুদূরপ্রসারী —

(১) বেকারত্ব : দেশীয় কুটিরশিল্প ধ্বংসের ফলে ভারতের বিপুল সংখ্যক হস্তশিল্পী ও কারিগর কাজ হারায়। নরেন্দ্রকৃয় সিংহের মতে, শুধু বাংলাতেই ১০ লক্ষ মানুষ কাজ হারিয়েছিল। কর্মচ্যুত হওয়ার ফলে দেশে তীব্র বেকার সমস্যা দেখা দেয়। সব্যসাচী ভট্টাচার্যের মতে, “যদি দেশের মানুষ শিল্পকর্ম ছেড়ে চাষ-আবাদে জীবিকা অর্জন শুরু করে অথবা জাতীয় আয়ে কৃষিজ অংশ বাড়তে থাকে ও শিল্পজ অংশ কমতে থাকে তবে তাকে অব-শিল্পায়ন বলে।”

(২) কৃষির ওপর চাপ: অব-শিল্পায়নের ফলে জমির অনুপাতে মানুষের সংখ্যা বেড়ে যায় ফলে তাদের জীবিকা নির্বাহে চাপ বাড়ে। দেশে কৃষিজীবী ও ভূমিহীন কৃষকের সংখ্যা ক্রমশ বৃদ্ধি পায়।

(৩) গ্ৰামীণ অর্থনীতিতে ভাঙন: অব-শিল্পায়ন ভারতের গ্ৰামীণ অর্থনীতিতে ভাঙন সৃষ্টি করে। স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রামগুলির দারিদ্র্য বৃদ্ধি পেলে সেখানে অর্থনৈতিক সমস্যা তীব্রতর হয়। অর্থনীতি সম্পূর্ণরূপে কৃষিনির্ভর হয়ে পড়ে। গ্রামে কৃষি মরসুম ছাড়া অন্য সময় মানুষের কাজ না থাকায় সার্বিকভাবে মানুষের গড় আয় যথেষ্ট কমে যায়।

(৪) নগরজীবনের অবক্ষয়: অব-শিল্পায়নের ফলে ভারতের প্রাচীন ও সমৃদ্ধ শহরগুলির অবক্ষয় শুরু হয়। অষ্টাদশ শতকে ঢাকা, মুরশিদাবা পর সুরাট, মসুলিপট্টম, তাঞ্জোর প্রভৃতি নগর ক্রমে জনবিরল হতে থাকে এবং নগরের অবক্ষয় শুরু হয় ।

(৫) কাঁচামাল রপ্তানিকারক দেশ: অব-শিল্পায়নের ফলে ভারতবা একটি কাঁচামাল রপ্তানিকারক দেশে পরিণত হয়। এখানকার কাঁচামাল সস্তায় ক্রয় করে ইংরেজ বণিকরা ইংল্যান্ডে রপ্তানি করতে থাকে। ভারতের কাঁচা তুলো, কাঁচা রেশম, নীল, চা প্রভৃতি কাঁচামাল নিয়মিত বিলাতের কারখানাগুলিতে চলে যেতে থাকে। এর ফলে ইংল্যান্ডের শিল্পায়নে গতি আসে।পরাধীন উপনিবেশগুলি থেকে কাঁচামাল নিয়ে গিয়ে ইংল্যান্ডে কারখানা গড়ে তোলার সমালোচনা করে ফ্রেডারিক এঙ্গেলস তাঁর 'On colonialism' গ্রন্থে লিখেছেন ইংল্যান্ড হবে পৃথিবীর কারখানা আর তার পদানত দেশগুলি হবে তার কৃষিলেজুর।

(৬) বিলাতি পণ্য আমদানি : দেশীয় শিল্পের ধ্বংসের ফলে ভারত একটি রপ্তানিকারক থেকে আমদানিকারক দেশে পরিণত হয়। বিলাতের ম্যাস্টোর, ল্যাঙ্কাশায়ার ও অন্যান্য স্থানের শিল্পজাত পণ্য ভারতে আমদানি শুরু হয়। কেবল সুতিবস্ত্র নয়, রেশম ও পশমজাত দ্রব্য, লোহা, মৃৎশিল্প, কাচ, অস্ত্রশস্ত্র, ঢাল-তলোয়ার, খোদাই ও কারুকার্যের সঙ্গে জড়িত শিল্প প্রভৃতির যথেচ্ছ আমদানির ফলে দেশীয় শিল্পগুলি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। 

(৭) দারিদ্র্য বৃদ্ধি : অব-শিল্পায়নের ফলে ভারতের অর্থনীতি ধ্বংস হয় এবং দারিদ্র্য বৃদ্ধি পায়। দারিদ্র্য, দুর্ভিক্ষ ও মহামারি ভারতীয় জনজীবনের নিত্যসঙ্গী হয়ে ওঠে।

(৮) চিনি শিল্পের ক্ষতিসাধন :  বিহার ও বারাণসীর চিনি কেন্দ্রগুলির উৎপাদিত চিনি কলকাতা বন্দর হয়ে ব্রিটেনে রপ্তানি হত। এক্ষেত্রে এর শুল্ক ও পরিবহন খরচ ছিল এমনিতেই বেশি। তার ওপর ব্রিটিশ চিনি শিল্পের ওপর তিনগুণ বেশি কর চাপায়। এর ফলে, আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় ভারতীয় চিনি শিল্প পিছিয়ে পড়ে।

(৯) জাহাজ শিল্পের ধ্বংসসাধন:  রামদুলাল দে, রামগোপাল মল্লিক, মদন দত্ত, পাঁচু দত্ত প্রমুখ বাঙালি জাহাজ মালিকদের উদ্যোগে জাহাজ নির্মাণ শিল্পের বিকাশ ঘটেছিল। কিন্তু ১৮১৪ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটেনের কর্তৃপক্ষ ভারত- ব্রিটেন বাণিজ্যে দেশীয় জাহাজ ব্যবহারের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলে জাহাজ শিল্পের বিকাশ ব্যাহত হয়। এ ছাড়া সরকারি তরফে বাষ্পীয় পোতের অনুপ্রবেশ এবং জাহাজ নির্মাণ রীতিতে বেশ কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করা হলে জাহাজ শিল্পের ধ্বংসসাধন ঘটে।

(১০) সূক্ষ্ম ও শৌখিন শিল্পের অবলুপ্তি :  দেশীয় রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায়, দেশীয় রাজ্যগুলি শৌখিন শিল্প ও সুদ্ধ মসলিন কাপড়ের উৎপাদনের জন্য বিখ্যাত ছিল। কিন্তু কোম্পানি দেশীয় রাজাগুলি দখল করে নিলে এবং সেগুলিকে বিদেশি পণ্যের বাজারে পরিণত করলে সূক্ষ্ম ও শৌখিন শিল্পের অপমৃত্যু ঘটে।


      ড. বিপান চন্দ্রের মতে, ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দের পর থেকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাণিজ্যনীতি ব্রিটিশ শিল্প ও শিল্পপতিদের স্বার্থেই পরিচালিত হয়েছিল। এর একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল ভারতবাসীকে জীবনধারণের প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির জন্য ব্রিটেনের মুখাপেক্ষী করে রাখা এবং ভারত থেকে ব্রিটিশ পণ্যের জন্য কাঁচামাল আহরণ। মার্কিন গবেষক ডেভিড মরিস মনে করেন যে, অবশিল্পায়নের ধারণা জাতীয়তাবাদী ঐতিহাসিকদের প্রচারিত এক ‘অলীক কল্পনা' বা মিথ। কিন্তু ড. বিপান চন্দ্র, ড. সব্যসাচী ভট্টাচার্য, ড. অমিয় বাগচি, ড. তপন রায়চৌধুরী প্রমুখ অব-শিল্পায়নকে একটি বাস্তব ঘটনা বলে মনে করেন।



মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ বিষয়ে হবসন-লেনিনের তত্ত্ব আলোচনা করো।

উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ বিষয়ে হবসন-লেনিনের তত্ত্ব: ভূমিকা: আধুনিক বিশ্বের সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির উপনিবেশ প্রসারের কৌশল ‘নয়া উপনিবেশবাদ’ ও ‘নয়া সাম্রাজ্যবাদ’ নামে পরিচিত। উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক বিষয়কে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করে জে. এ. হবসন এবং ভি. আই. লেনিন সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদ সম্পর্কে তাদের অর্থনৈতিক ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন। হবসনের ব্যাখ্যা:  ব্রিটিশ অর্তনীতিবিদ জে. এ. হবসন তাঁর ‘সাম্রাজ্যবাদঃ একটি সমীক্ষা’ নামক গ্রন্থে সাম্রাজ্যবাদ ও ঔপনিবেশিকতাবাদের অর্থনৈতিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তাঁর ব্যাখ্যার প্রধান বিষয়গুলি হল—  [1] অর্থনৈতিক মুনাফা লাভ: হবসনের মতে, সাম্রাজ্যবাদের পিছনে কোনো মহৎ, বা উচ্চতর লক্ষ্য নয়, অর্থনৈতিক মুনাফাই ছিল নয়া উপনিবেশকারীদের প্রধানতম উদ্দেশ্য। পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় সমাজে ধনসম্পদ বণ্টনের ক্ষেত্রে ব্যাপক বৈষম্যের ফলে পুঁজিপতিদের হাতে যে ‘মূলধনের পাহাড়' সৃষ্টি হয়, সেই মূলধন নতুন ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করে তারা মুনাফা লাভের পরিকল্পনা করে। [2] পুঁজিপতিদের চাপ: হবসন মনে করেন যে, নতুন ক্ষেত্রে মূলধন বিনিয়োগ করা...

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও। এই যুদ্ধে ভারতের ভূমিকা কী ছিল ?

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ: সূচনা: ১৯৬০-এর দশকের শেষদিকে আওয়ামি লিগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে পূর্ববঙ্গের স্বাধীনতার দাবিতে আন্দোলন শুরু হয়। ১৯৬৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে বাংলাদেশের মুক্তি আন্দোলন চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছোয়। (1) মিথ্যা মামলায় জড়ানো: শেখ মুজিবুরসহ অন্যান্য আওয়ামি লিগ নেতাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয় যে, তারা ভারতের সঙ্গে মিলে পাকিস্তানের অখণ্ডতার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। এই অভিযোগে পাক সরকার ১৯৬৮ খ্রিস্টাব্দের প্রথমদিকে শেখ মুজিবুরসহ ৩৫ জন নেতাকে গ্রেপ্তার করে মিথ্যা আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় ফাঁসিয়ে দেয়। ফলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ তীব্র হয়ে ওঠে। প্রবল আন্দোলনের চাপে পাক সরকার মামলা প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়। (2) সাধারণ নির্বাচন: পূর্ব ও পশ্চিম উভয় পাকিস্তানের সরকার- বিরোধী অসন্তোষ বাড়তে থাকলে পাকিস্তানের সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খান ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে দেশে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত করেন। এই নির্বাচনে মুজিবের নেতৃত্বাধীন আওয়ামি লিগ পূর্ব পাকিস্তানের ১৬২টি আসনের মধ্যে ১৬০টি আসন লাভ করে। পশ্চিম পাকিস্তানের ১৪০টি আসনের মধ্যে জুলফিকার আলি ভুট্টোর পিপলস পাটি ...

সুয়েজ সংকটের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও।

সুয়েজ সংকটের সংক্ষিপ্ত পরিচয়ঃ  সূচনা: মিশর দেশের উত্তর-পূর্ব দিকে ইংরেজ ও ফরাসিদের তত্ত্বাবধানে খনন করা একটি খাল হল সুয়েজ খাল। ১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে ওই খাল খনন শুরু হলেও ১৮৬৯ থেকে এতে বাণিজ্যিকভাবে জাহাজ চলাচল শুরু হয়। ইউনিভার্সাল সুয়েজ ক্যানাল কোম্পানি নামে এক সংস্থাকে একটি চুক্তির ভিত্তিতে ৯৯ বছরের জন্য খালটি পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার আগেই ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দের ২৬ জুলাই মিশরের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি গামাল আবদেল নাসের এক ঘোষণাবলে সুয়েজ খাল ও সুয়েজ ক্যানাল কোম্পানি—দুটিকেই জাতীয়করণ করে নেন। বিশ্বজুড়ে এই সমস্যাকেই সুয়েজ সংকট বোঝায়। সুয়েজ সংকটের কারণঃ (১) ব্রিটেন ও ফ্রান্সের দায়িত্ব: আরব-ইজরায়েল দ্বন্দ্ব চলাকালে ব্রিটেন ও ফ্রান্স ইজরায়েলকে অস্ত্র সরবরাহের সিদ্ধান্ত নিলে আরব দেশগুলি ক্ষুব্ধ হয় এবং নাসেরের সঙ্গেও পাশ্চাত্য দেশগুলির মনোমালিন্য শুরু হয়। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ব্রিটেন ও ফ্রান্সই সুয়েজ খালের ওপর সবথেকে বেশি নির্ভরশীল ছিল। মার্কিন বিদেশমন্ত্রী ডালেস যখন সুয়েজ খাল ব্যবহারকারী দেশগুলিকে নিয়ে এক সংস্থা গঠনের প্রস্তাব দেন তখ...

জোটনিরপেক্ষ নীতি কী ? জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের উদ্দেশ্য ও গুরুত্ব লেখো।

জোটনিরপেক্ষ নীতিঃ     দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে একদিকে সোভিয়েত রাশিয়ার নেতৃত্বে সাম্যবাদী বা সমাজতান্ত্রিক জোট, অপরদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পুঁজিবাদী বা ধনতান্ত্রিক রাষ্ট্রজোট গঠিত হয়। এই দুই জোটের কোনোটিতেই যোগ না দিয়ে, স্বাধীনভাবে উভয় জোটের সঙ্গেই বন্ধুত্ব বা সমদূরত্ব বজায় রেখে সম্পূর্ণ স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে বৈদেশিক সম্পর্ক পরিচালনার নীতি জোটনিরপেক্ষ নীতি নামে পরিচিত। জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের কারণ বা উদ্দেশ্য ঃ    মার্কিন নেতৃত্বাধীন পুঁজিবাদী জোট ও সোভিয়েত নেতৃত্বাধীন সাম্যবাদী জোটের পারস্পরিক দ্বন্দ্ব থেকে উদ্ভূত ‘ঠান্ডা লড়াই'-এর আর্বত থেকে নিজেকে দূরে রেখে, জাতীয় স্বার্থ ও নবলব্ধ স্বাধীনতাকে রক্ষার জন্য ভারত জোটনিরপেক্ষ বিদেশনীতি গ্রহণ করে। ভারতে জোটনিরপেক্ষ নীতি গ্রহণের কারণগুলি হল— [1] ভৌগোলিক সুরক্ষা : এশিয়া মহাদেশের দক্ষিণে এমন একটা জায়গায় ভারতের অবস্থান যা তাকে মধ্যপ্রাচ্য। ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে সংযোগ স্থাপনকারী দেশে পরিণত করেছে। আফগানিস্তান, পাকিস্তান, নেপাল, ভুটান, চিন, ব্রহ্মদেশ, শ্রীলঙ্কা এবং দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশি...