সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

জোলভেরাইন কিভাবে জার্মান জাতীয়তাবাদের প্রতিপালন বা উৎসাহিত করেছিল ?

জোলভেরাইন ও জার্মান জাতীয়তাবাদ

জোলভেরাইন কিভাবে জার্মান জাতীয়তাবাদের প্রতিপালন বা উৎসাহিত করেছিল ?


        ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দের ভিয়েনা কংগ্রেসের বন্দোবস্তের প্রতিবাদ হিসাবে জার্মান জাতীয়তাবাদ দ্রুত প্রবল হয়ে উঠতে শুরু করে। তবে রাজনৈতিক ক্ষেত্র অপেক্ষা অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে জার্মানীর রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতার প্রচেষ্টা জাতীয় সংহতি স্থাপন করতে বিশেষভাবে সাহায্য করে। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধ পর্যন্ত বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে জার্মানী খুবই অনুন্নত ছিল। কৃষিপ্রধান জার্মানীতে কয়েকটি প্রয়োজনীয় কুটির শিল্প গড়ে উঠলেও স্থানীয় চাহিদা পূরণ করার মধ্যেই তাদের ক্ষমতা সীমাবদ্ধ ছিল। তাছাড়া জার্মানীর প্রতিটি অঞ্চলে বিভিন্ন প্রকার শুল্ক প্রাচীর গড়ে ওঠার ফলে শিল্প, বাণিজ্য প্রভৃতির সম্প্রসারণের প্রায় কোন সুযোগই ছিল না। একমাত্র প্রাশিয়ায় প্রায় সাতষট্টি প্রকার শুল্ক প্রচলিত ছিল। ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে প্রাশিয়ার সংহতি ও অর্থনৈতিক শৃঙ্খলা স্থাপনের উদ্দেশ্যে নতুন একটি আইন প্রণয়ন করে। এই আইন অনুসারে সকল প্রকার কাঁচামাল প্রাশিয়ায় আমদানি শুরু হয়, শিল্পজাত পণ্যদ্রব্যের ওপর নির্দিষ্ট হারে শুল্ক ধার্য করা হয় এবং সকলপ্রকার অভ্যন্তরীণ শুল্ক বাতিল করা হয়। অর্থনীতিবিদ অ্যাডাম স্মিথের অবাধ বাণিজ্য নীতির ওপর ভিত্তি করে প্রাশিয়া এই ব্যবস্থা অবলম্বন করে। এই ব্যবস্থা অবলম্বনের ফলে পূর্ব ও পশ্চিম প্রাশিয়ার মধ্যে সংহতি স্থাপিত হয় এবং প্রাশিয়ার রাজতন্ত্র শক্তিশালী হয়। কিন্তু প্রাশিয়া এককভাবে এই শিল্পনীতি গ্রহণ করায় জার্মানীর অন্যান্য রাষ্ট্র অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়। এই অবস্থায় প্রাশিয়া ক্রমপর্যায়ে শুল্ক নীতির মাধ্যমে জার্মানীর অর্থনৈতিক ঐক্য গড়ে তোলার চেষ্টা শুরু করে। ১৮১৯ খ্রিস্টাব্দে প্রাশিয়া প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে কয়েকটি শুল্ক চুক্তি সম্পাদন করে। এইসব চুক্তির দ্বারা স্থির হয় যে, শুল্ক থেকে যা আয় হবে তা জনসংখ্যার অনুপাতে উভয় রাষ্ট্রের মধ্যে বণ্টন করা হবে। ১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে উত্তর এবং মধ্য জার্মানী ছাড়া দক্ষিণ জার্মানীর রাষ্ট্রগুলো অনুরূপ চুক্তি সম্পাদন করে। ১৮৩৪ খ্রিস্টাব্দে জার্মানীর সতেরটি রাষ্ট্র প্রাশিয়ার সঙ্গে জোলভেরাইন (Zolleverein) নামে একটি শুল্ক সংখ প্রতিষ্ঠা করে। এই সঙ্ঘের সদস্যরাষ্ট্রগুলোর মধ্যে অবাধ বাণিজ্যের সূত্রপাত হয় এবং শুল্ক থেকে যা লাভ হত তা জনসংখ্যার অনুপাতে সদস্যরাষ্ট্রসমূহের মধ্যে বণ্টন করার ব্যবস্থা করা হয়। ১৮৫০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে অস্ট্রিয়া ব্যতীয় জার্মান রাষ্ট্রসঙ্ঘের (German Confederacy) অপরাপর সকল রাষ্ট্রই জোলভেরাইন-এ যোগ দেয়। 

         জার্মানীর ইতিহাসে এই শুল্ক সঙ্ঘের গুরুত্ব অপরিসীম। প্রাশিয়ার নেতৃত্বে অস্ট্রিয়া ব্যতীত সমগ্র জার্মানীর অর্থনৈতিক ঐক্য স্থাপিত হয়। জার্মানীর অর্থনৈতিক ঐক্য তার রাজনৈতিক ঐক্যস্থাপনের পথ সুগম করে। অর্থনৈতিক ঐক্যের প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে প্রাশিয়া জার্মানীর রাজনীতিতে নিজের প্রাধান্য স্থাপন করার সুযোগ পায়। অস্ট্রিয়াকে বাদ দিলে জার্মানীর ঐকা সাধন যে সম্ভব, জার্মানীর রাষ্ট্রগুলো তা এই সময় সর্বপ্রথম উপলব্ধি করতে সমর্থ হয়। এ জন্য শুল্ক সঙ্ঘের গুরুত্ব সম্পর্কে কেটেলবি মন্তব্য করেন, “জোলভেরাইন প্রত্যক্ষভাবে ১৮৭১ সালে স্থাপিত সাম্রাজ্যের ভিত্তি প্রস্তুত করে।” অপরদিকে এই শুল্কসংঘ স্থাপিত হওয়ার ফলে জার্মানীর সর্বত্র ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসারের ফলে বণিক ও শিল্পপতিগণ সন্তোষ লাভ করে এবং জার্মানীর অর্থনৈতিক ঐক্য আরও ঘনিষ্ঠ করে তোলার চেষ্টা করে।


মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ বিষয়ে হবসন-লেনিনের তত্ত্ব আলোচনা করো।

উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ বিষয়ে হবসন-লেনিনের তত্ত্ব: ভূমিকা: আধুনিক বিশ্বের সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির উপনিবেশ প্রসারের কৌশল ‘নয়া উপনিবেশবাদ’ ও ‘নয়া সাম্রাজ্যবাদ’ নামে পরিচিত। উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক বিষয়কে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করে জে. এ. হবসন এবং ভি. আই. লেনিন সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদ সম্পর্কে তাদের অর্থনৈতিক ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন। হবসনের ব্যাখ্যা:  ব্রিটিশ অর্তনীতিবিদ জে. এ. হবসন তাঁর ‘সাম্রাজ্যবাদঃ একটি সমীক্ষা’ নামক গ্রন্থে সাম্রাজ্যবাদ ও ঔপনিবেশিকতাবাদের অর্থনৈতিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তাঁর ব্যাখ্যার প্রধান বিষয়গুলি হল—  [1] অর্থনৈতিক মুনাফা লাভ: হবসনের মতে, সাম্রাজ্যবাদের পিছনে কোনো মহৎ, বা উচ্চতর লক্ষ্য নয়, অর্থনৈতিক মুনাফাই ছিল নয়া উপনিবেশকারীদের প্রধানতম উদ্দেশ্য। পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় সমাজে ধনসম্পদ বণ্টনের ক্ষেত্রে ব্যাপক বৈষম্যের ফলে পুঁজিপতিদের হাতে যে ‘মূলধনের পাহাড়' সৃষ্টি হয়, সেই মূলধন নতুন ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করে তারা মুনাফা লাভের পরিকল্পনা করে। [2] পুঁজিপতিদের চাপ: হবসন মনে করেন যে, নতুন ক্ষেত্রে মূলধন বিনিয়োগ করা...

অবশিল্পায়ন কি ? ঔপনিবেশিক ভারতে অবশিল্পায়নের কারণ ও ফলাফল লেখো ।

অবশিল্পায়নঃ        অবশিল্পায়ন বলতে বোঝায় শিল্পায়নের বিপরীত বা শিল্পের অধোগতি। অর্থাৎ ব্রিটিশ শাসনধীন ভারতের চিরাচরিত ও ঐতিহ্যশালী হস্তশিল্প-কুটিরশিল্পের ধ্বংস সাধনই মূলত অবশিল্পায়ন। সব্যসাচী ভট্টাচার্যের মতে যদি দেশের মানুষ শিল্প-কর্ম ছেড়ে চাষ-আবাদে জীবিকা অর্জন শুরু করে অথবা জাতীয় কৃষিজ ও অংশ বাড়তে থাকে এবং শিল্পজ অংশ কমতে থাকে তাকে অব-অবশিল্পায় বলে। অবশিল্পায়নের ফলে ভারতের অর্থনৈতিক ভারসাম্য নষ্ট হয়। ব্রিটিশ শাসনকালে ভারতের অবশিল্পায়ন সম্পর্কে প্রথম পর্বে দাদাভাই নাও রোজি, রমেশ চন্দ্র দত্ত, মহাদেব গোবিন্দ রানাডে প্রমুখ জাতীয়তাবাদী নেতা এবং পরবর্তীকালে রজনীপাম দত্ত জাতীয়তাবাদী নেতা এবং পরবর্তীকালে রজনী পামদত্ত, গ্যাডগিল, বি.ডি. বসু, নরেন্দ্রকৃয় সিংহ, বিপান চন্দ্র, অমিয় বাগচি প্রমুখ ঐতিহাসিক আলোচনা করেছেন। অব-শিল্পায়নের কারণঃ (১) কাঁচামালের রপ্তানি: ভারতীয় শিল্পের ধ্বংসের সঙ্গে সঙ্গে ভারত থেকে ইংল্যান্ডে কাঁচামাল রপ্তানি শুরু হয়। ভারত ইংল্যান্ডের কলকারখানার খোলা বাজার ও কাঁচামাল সরবরাহের উৎসে পরিণত হয়। ভারত থেকে তুলো, নীল, কফি, চা, রেশম প্রভৃতি ইং...

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও। এই যুদ্ধে ভারতের ভূমিকা কী ছিল ?

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ: সূচনা: ১৯৬০-এর দশকের শেষদিকে আওয়ামি লিগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে পূর্ববঙ্গের স্বাধীনতার দাবিতে আন্দোলন শুরু হয়। ১৯৬৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে বাংলাদেশের মুক্তি আন্দোলন চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছোয়। (1) মিথ্যা মামলায় জড়ানো: শেখ মুজিবুরসহ অন্যান্য আওয়ামি লিগ নেতাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয় যে, তারা ভারতের সঙ্গে মিলে পাকিস্তানের অখণ্ডতার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। এই অভিযোগে পাক সরকার ১৯৬৮ খ্রিস্টাব্দের প্রথমদিকে শেখ মুজিবুরসহ ৩৫ জন নেতাকে গ্রেপ্তার করে মিথ্যা আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় ফাঁসিয়ে দেয়। ফলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ তীব্র হয়ে ওঠে। প্রবল আন্দোলনের চাপে পাক সরকার মামলা প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়। (2) সাধারণ নির্বাচন: পূর্ব ও পশ্চিম উভয় পাকিস্তানের সরকার- বিরোধী অসন্তোষ বাড়তে থাকলে পাকিস্তানের সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খান ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে দেশে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত করেন। এই নির্বাচনে মুজিবের নেতৃত্বাধীন আওয়ামি লিগ পূর্ব পাকিস্তানের ১৬২টি আসনের মধ্যে ১৬০টি আসন লাভ করে। পশ্চিম পাকিস্তানের ১৪০টি আসনের মধ্যে জুলফিকার আলি ভুট্টোর পিপলস পাটি ...

সুয়েজ সংকটের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও।

সুয়েজ সংকটের সংক্ষিপ্ত পরিচয়ঃ  সূচনা: মিশর দেশের উত্তর-পূর্ব দিকে ইংরেজ ও ফরাসিদের তত্ত্বাবধানে খনন করা একটি খাল হল সুয়েজ খাল। ১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে ওই খাল খনন শুরু হলেও ১৮৬৯ থেকে এতে বাণিজ্যিকভাবে জাহাজ চলাচল শুরু হয়। ইউনিভার্সাল সুয়েজ ক্যানাল কোম্পানি নামে এক সংস্থাকে একটি চুক্তির ভিত্তিতে ৯৯ বছরের জন্য খালটি পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার আগেই ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দের ২৬ জুলাই মিশরের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি গামাল আবদেল নাসের এক ঘোষণাবলে সুয়েজ খাল ও সুয়েজ ক্যানাল কোম্পানি—দুটিকেই জাতীয়করণ করে নেন। বিশ্বজুড়ে এই সমস্যাকেই সুয়েজ সংকট বোঝায়। সুয়েজ সংকটের কারণঃ (১) ব্রিটেন ও ফ্রান্সের দায়িত্ব: আরব-ইজরায়েল দ্বন্দ্ব চলাকালে ব্রিটেন ও ফ্রান্স ইজরায়েলকে অস্ত্র সরবরাহের সিদ্ধান্ত নিলে আরব দেশগুলি ক্ষুব্ধ হয় এবং নাসেরের সঙ্গেও পাশ্চাত্য দেশগুলির মনোমালিন্য শুরু হয়। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ব্রিটেন ও ফ্রান্সই সুয়েজ খালের ওপর সবথেকে বেশি নির্ভরশীল ছিল। মার্কিন বিদেশমন্ত্রী ডালেস যখন সুয়েজ খাল ব্যবহারকারী দেশগুলিকে নিয়ে এক সংস্থা গঠনের প্রস্তাব দেন তখ...

জোটনিরপেক্ষ নীতি কী ? জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের উদ্দেশ্য ও গুরুত্ব লেখো।

জোটনিরপেক্ষ নীতিঃ     দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে একদিকে সোভিয়েত রাশিয়ার নেতৃত্বে সাম্যবাদী বা সমাজতান্ত্রিক জোট, অপরদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পুঁজিবাদী বা ধনতান্ত্রিক রাষ্ট্রজোট গঠিত হয়। এই দুই জোটের কোনোটিতেই যোগ না দিয়ে, স্বাধীনভাবে উভয় জোটের সঙ্গেই বন্ধুত্ব বা সমদূরত্ব বজায় রেখে সম্পূর্ণ স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে বৈদেশিক সম্পর্ক পরিচালনার নীতি জোটনিরপেক্ষ নীতি নামে পরিচিত। জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের কারণ বা উদ্দেশ্য ঃ    মার্কিন নেতৃত্বাধীন পুঁজিবাদী জোট ও সোভিয়েত নেতৃত্বাধীন সাম্যবাদী জোটের পারস্পরিক দ্বন্দ্ব থেকে উদ্ভূত ‘ঠান্ডা লড়াই'-এর আর্বত থেকে নিজেকে দূরে রেখে, জাতীয় স্বার্থ ও নবলব্ধ স্বাধীনতাকে রক্ষার জন্য ভারত জোটনিরপেক্ষ বিদেশনীতি গ্রহণ করে। ভারতে জোটনিরপেক্ষ নীতি গ্রহণের কারণগুলি হল— [1] ভৌগোলিক সুরক্ষা : এশিয়া মহাদেশের দক্ষিণে এমন একটা জায়গায় ভারতের অবস্থান যা তাকে মধ্যপ্রাচ্য। ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে সংযোগ স্থাপনকারী দেশে পরিণত করেছে। আফগানিস্তান, পাকিস্তান, নেপাল, ভুটান, চিন, ব্রহ্মদেশ, শ্রীলঙ্কা এবং দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশি...