সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

ভারত সম্পর্কে আল-বিরুনির দৃষ্টিভঙ্গি কী ছিল ?

ভারত সম্পর্কে আল-বিরুনির দৃষ্টিভঙ্গি


   অনন্যসাধারণ প্রতিভার অধিকারী বিখ্যাত প্রাচ্যতত্ত্ববিদ অল বিরুনি মধ্য এশিয়ায় অবস্থিত খোয়ারজিয় রাজ্যের রাজধানী খিভাতে ৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। গজনীর শাসনকর্তা সুলতান মামুদ যখন খিভা অধিকার করেন সেই সময় অলবিরুনি বন্দী হন। বন্দী অবস্থায় তাঁকে গজনীতে নিয়ে আসা হয়। সুলতান মামুদ অলবিরুনির প্রতিভা ও পাণ্ডিত্যের পরিচয় পেয়ে তাঁকে আপন রাজসভায় সভাসদ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করেন। সুলতান মামুদের ভারত আক্রমণের কালে অলবিরুনি এদেশে এসে এখানকার পণ্ডিতদের জ্ঞান ও বিদ্যাচর্চার প্রতি নিষ্ঠা দেখে অভিভূত হন। তিনি ভারতীয় দর্শন, জ্যোতির্বিজ্ঞান, গণিত প্রভৃতি বিষয়ে গভীর আগ্রহ প্রকাশ করতে থাকেন। তিনি সংস্কৃত ভাষা আয়ত্ত করেন এবং ভারতীয় ঞ্জান- বিজ্ঞানের চর্চায় নিজেকে নিযুক্ত করেন। তিনি ভারতবর্ষ সম্পর্কে একটি গ্রন্থ রচনা করেন। তাঁর রচিত গ্রন্থটি ‘তহকিক-ই-হিন্দ’ নামে পরিচিত। এই গ্রন্থ থেকে দশম শতাব্দীর শেষভাগ এবং একাদশ শতাব্দীর প্রথমভাগের উত্তর, মধ্য ও উত্তর-পশ্চিম ভারতের রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনের একটি মনোজ্ঞ চিত্র পাওয়া যায়। সুলতান মামুদের ভারত আক্রমণে এদেশের যে প্রভূত ক্ষতি হয়েছিল একথা প্রকাশ করতে তিনি কোন দ্বিধা বোধ করেননি। আবার হিন্দুদের প্রধান ত্রুটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে অলবিরুনি বলেন যে, বহিঃপৃথিবীর সঙ্গে তাদের সম্পর্ক ছিন্ন হয়েছিল এবং পৃথিবীর অপরাপর জাতিদের সঙ্গে কোনরূপ সম্পর্ক ছিল না। তারা অপরজাতির সকল মানুষকেই অস্পৃশ্য মনে করতো।

‌      অলবিরুনির বিবরণ থেকে জানা যায় যে তৎকালীন সময়ে ভারতে রাজনৈতিক ঐক্য বলে কিছু ছিল না। সম্পূর্ণ উত্তরভারত অনেকগুলো স্বাধীন রাজ্যে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। এরূপ রাজ্যগুলোর মধ্যে প্রধান হল কাশ্মীর, সিন্ধু, মালব এবং কনৌজ। এই রাজ্যগুলোর পরস্পরের মধ্যে সর্বদাই যুদ্ধ-বিগ্রহ লেগে থাকত। বৈদেশিক আক্রমণের বিরুদ্ধে এ সকল রাজ্যগুলো কোন ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধের পরিকল্পনা গ্রহণ করেনি। রাজনৈতিক দূরদর্শিতার অভাব এরূপ মনোবৃত্তির কারণ বলে অলবিরুনি উল্লেখ করেন।

       ভারতীয় সমাজে জাতিভেদ প্রথা প্রচলিত ছিল এবং বিভিন্ন বর্ণের মানুষের মধ্যে নানারকম পার্থক্য ছিল। এই জাতিভেদ প্রথাকে অলবিরুনি ভারতীয় সমাজ ব্যবস্থার সর্বাপেক্ষা ক্ষতিকারক রীতি বলে উল্লেখ করেন। বাল্যবিবাহ সামাজিক জীবনের প্রচলিত নিয়ম ছিল। পিতা-মাতা ও অভিভাবকগণ বালক-বালিকাদের এইরূপ বিবাহের আয়োজন করতেন। বিধবা নারীর পুনর্বিবাহ সামাজিক জীবনে সর্বাপেক্ষা নিন্দনীয় অপরাধ বলে অভিহিত হত। স্বামীর মৃত্যু হলে সেই নারীকে যাবজ্জীবন বৈধব্য যন্ত্রণা ভোগ করতে হত। পুরুষরা একাধিক বিবাহ করার অধিকারী ছিল। স্বামী যে অর্থ বা সম্পত্তি স্ত্রীকে দান করতেন তা ‘স্ত্রী-ধন’ নামে পরিচিত হত। 

       হিন্দুরা বহু দেব-দেবীর পূজার্চনা করতেন, যদিও জ্ঞানীগুণীগণ ঈশ্বর এক এবং অদ্বিতীয় এই মতে বিশ্বাসী ছিলেন। তবে এই সময় ধর্ম আচারসর্বস্ব হয়ে উঠেছিল এবং হিন্দুধর্ম মূল আধ্যাত্মিক চিন্তা থেকে অনেক দূরে সরে আসে। ধর্মীয় জীবনে উদ্দীপনা সৃষ্টিকারী কোন আদর্শ বর্তমান ছিল না। ফলে সামাজিক জীবনেও ঐক্যবোধের প্রচণ্ড অভাব দেখা দেয়।


মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ বিষয়ে হবসন-লেনিনের তত্ত্ব আলোচনা করো।

উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ বিষয়ে হবসন-লেনিনের তত্ত্ব: ভূমিকা: আধুনিক বিশ্বের সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির উপনিবেশ প্রসারের কৌশল ‘নয়া উপনিবেশবাদ’ ও ‘নয়া সাম্রাজ্যবাদ’ নামে পরিচিত। উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক বিষয়কে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করে জে. এ. হবসন এবং ভি. আই. লেনিন সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদ সম্পর্কে তাদের অর্থনৈতিক ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন। হবসনের ব্যাখ্যা:  ব্রিটিশ অর্তনীতিবিদ জে. এ. হবসন তাঁর ‘সাম্রাজ্যবাদঃ একটি সমীক্ষা’ নামক গ্রন্থে সাম্রাজ্যবাদ ও ঔপনিবেশিকতাবাদের অর্থনৈতিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তাঁর ব্যাখ্যার প্রধান বিষয়গুলি হল—  [1] অর্থনৈতিক মুনাফা লাভ: হবসনের মতে, সাম্রাজ্যবাদের পিছনে কোনো মহৎ, বা উচ্চতর লক্ষ্য নয়, অর্থনৈতিক মুনাফাই ছিল নয়া উপনিবেশকারীদের প্রধানতম উদ্দেশ্য। পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় সমাজে ধনসম্পদ বণ্টনের ক্ষেত্রে ব্যাপক বৈষম্যের ফলে পুঁজিপতিদের হাতে যে ‘মূলধনের পাহাড়' সৃষ্টি হয়, সেই মূলধন নতুন ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করে তারা মুনাফা লাভের পরিকল্পনা করে। [2] পুঁজিপতিদের চাপ: হবসন মনে করেন যে, নতুন ক্ষেত্রে মূলধন বিনিয়োগ করা...

অবশিল্পায়ন কি ? ঔপনিবেশিক ভারতে অবশিল্পায়নের কারণ ও ফলাফল লেখো ।

অবশিল্পায়নঃ        অবশিল্পায়ন বলতে বোঝায় শিল্পায়নের বিপরীত বা শিল্পের অধোগতি। অর্থাৎ ব্রিটিশ শাসনধীন ভারতের চিরাচরিত ও ঐতিহ্যশালী হস্তশিল্প-কুটিরশিল্পের ধ্বংস সাধনই মূলত অবশিল্পায়ন। সব্যসাচী ভট্টাচার্যের মতে যদি দেশের মানুষ শিল্প-কর্ম ছেড়ে চাষ-আবাদে জীবিকা অর্জন শুরু করে অথবা জাতীয় কৃষিজ ও অংশ বাড়তে থাকে এবং শিল্পজ অংশ কমতে থাকে তাকে অব-অবশিল্পায় বলে। অবশিল্পায়নের ফলে ভারতের অর্থনৈতিক ভারসাম্য নষ্ট হয়। ব্রিটিশ শাসনকালে ভারতের অবশিল্পায়ন সম্পর্কে প্রথম পর্বে দাদাভাই নাও রোজি, রমেশ চন্দ্র দত্ত, মহাদেব গোবিন্দ রানাডে প্রমুখ জাতীয়তাবাদী নেতা এবং পরবর্তীকালে রজনীপাম দত্ত জাতীয়তাবাদী নেতা এবং পরবর্তীকালে রজনী পামদত্ত, গ্যাডগিল, বি.ডি. বসু, নরেন্দ্রকৃয় সিংহ, বিপান চন্দ্র, অমিয় বাগচি প্রমুখ ঐতিহাসিক আলোচনা করেছেন। অব-শিল্পায়নের কারণঃ (১) কাঁচামালের রপ্তানি: ভারতীয় শিল্পের ধ্বংসের সঙ্গে সঙ্গে ভারত থেকে ইংল্যান্ডে কাঁচামাল রপ্তানি শুরু হয়। ভারত ইংল্যান্ডের কলকারখানার খোলা বাজার ও কাঁচামাল সরবরাহের উৎসে পরিণত হয়। ভারত থেকে তুলো, নীল, কফি, চা, রেশম প্রভৃতি ইং...

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও। এই যুদ্ধে ভারতের ভূমিকা কী ছিল ?

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ: সূচনা: ১৯৬০-এর দশকের শেষদিকে আওয়ামি লিগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে পূর্ববঙ্গের স্বাধীনতার দাবিতে আন্দোলন শুরু হয়। ১৯৬৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে বাংলাদেশের মুক্তি আন্দোলন চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছোয়। (1) মিথ্যা মামলায় জড়ানো: শেখ মুজিবুরসহ অন্যান্য আওয়ামি লিগ নেতাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয় যে, তারা ভারতের সঙ্গে মিলে পাকিস্তানের অখণ্ডতার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। এই অভিযোগে পাক সরকার ১৯৬৮ খ্রিস্টাব্দের প্রথমদিকে শেখ মুজিবুরসহ ৩৫ জন নেতাকে গ্রেপ্তার করে মিথ্যা আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় ফাঁসিয়ে দেয়। ফলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ তীব্র হয়ে ওঠে। প্রবল আন্দোলনের চাপে পাক সরকার মামলা প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়। (2) সাধারণ নির্বাচন: পূর্ব ও পশ্চিম উভয় পাকিস্তানের সরকার- বিরোধী অসন্তোষ বাড়তে থাকলে পাকিস্তানের সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খান ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে দেশে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত করেন। এই নির্বাচনে মুজিবের নেতৃত্বাধীন আওয়ামি লিগ পূর্ব পাকিস্তানের ১৬২টি আসনের মধ্যে ১৬০টি আসন লাভ করে। পশ্চিম পাকিস্তানের ১৪০টি আসনের মধ্যে জুলফিকার আলি ভুট্টোর পিপলস পাটি ...

সুয়েজ সংকটের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও।

সুয়েজ সংকটের সংক্ষিপ্ত পরিচয়ঃ  সূচনা: মিশর দেশের উত্তর-পূর্ব দিকে ইংরেজ ও ফরাসিদের তত্ত্বাবধানে খনন করা একটি খাল হল সুয়েজ খাল। ১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে ওই খাল খনন শুরু হলেও ১৮৬৯ থেকে এতে বাণিজ্যিকভাবে জাহাজ চলাচল শুরু হয়। ইউনিভার্সাল সুয়েজ ক্যানাল কোম্পানি নামে এক সংস্থাকে একটি চুক্তির ভিত্তিতে ৯৯ বছরের জন্য খালটি পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার আগেই ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দের ২৬ জুলাই মিশরের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি গামাল আবদেল নাসের এক ঘোষণাবলে সুয়েজ খাল ও সুয়েজ ক্যানাল কোম্পানি—দুটিকেই জাতীয়করণ করে নেন। বিশ্বজুড়ে এই সমস্যাকেই সুয়েজ সংকট বোঝায়। সুয়েজ সংকটের কারণঃ (১) ব্রিটেন ও ফ্রান্সের দায়িত্ব: আরব-ইজরায়েল দ্বন্দ্ব চলাকালে ব্রিটেন ও ফ্রান্স ইজরায়েলকে অস্ত্র সরবরাহের সিদ্ধান্ত নিলে আরব দেশগুলি ক্ষুব্ধ হয় এবং নাসেরের সঙ্গেও পাশ্চাত্য দেশগুলির মনোমালিন্য শুরু হয়। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ব্রিটেন ও ফ্রান্সই সুয়েজ খালের ওপর সবথেকে বেশি নির্ভরশীল ছিল। মার্কিন বিদেশমন্ত্রী ডালেস যখন সুয়েজ খাল ব্যবহারকারী দেশগুলিকে নিয়ে এক সংস্থা গঠনের প্রস্তাব দেন তখ...

জোটনিরপেক্ষ নীতি কী ? জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের উদ্দেশ্য ও গুরুত্ব লেখো।

জোটনিরপেক্ষ নীতিঃ     দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে একদিকে সোভিয়েত রাশিয়ার নেতৃত্বে সাম্যবাদী বা সমাজতান্ত্রিক জোট, অপরদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পুঁজিবাদী বা ধনতান্ত্রিক রাষ্ট্রজোট গঠিত হয়। এই দুই জোটের কোনোটিতেই যোগ না দিয়ে, স্বাধীনভাবে উভয় জোটের সঙ্গেই বন্ধুত্ব বা সমদূরত্ব বজায় রেখে সম্পূর্ণ স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে বৈদেশিক সম্পর্ক পরিচালনার নীতি জোটনিরপেক্ষ নীতি নামে পরিচিত। জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের কারণ বা উদ্দেশ্য ঃ    মার্কিন নেতৃত্বাধীন পুঁজিবাদী জোট ও সোভিয়েত নেতৃত্বাধীন সাম্যবাদী জোটের পারস্পরিক দ্বন্দ্ব থেকে উদ্ভূত ‘ঠান্ডা লড়াই'-এর আর্বত থেকে নিজেকে দূরে রেখে, জাতীয় স্বার্থ ও নবলব্ধ স্বাধীনতাকে রক্ষার জন্য ভারত জোটনিরপেক্ষ বিদেশনীতি গ্রহণ করে। ভারতে জোটনিরপেক্ষ নীতি গ্রহণের কারণগুলি হল— [1] ভৌগোলিক সুরক্ষা : এশিয়া মহাদেশের দক্ষিণে এমন একটা জায়গায় ভারতের অবস্থান যা তাকে মধ্যপ্রাচ্য। ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে সংযোগ স্থাপনকারী দেশে পরিণত করেছে। আফগানিস্তান, পাকিস্তান, নেপাল, ভুটান, চিন, ব্রহ্মদেশ, শ্রীলঙ্কা এবং দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশি...