জাহান্দারী ও জাওবিৎ:
দিল্লীর সুলতানরা এমন রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তুললেন যা প্রাচীন পারস্যদেশীয় সাসানীয় নৃপতিদের থেকে স্বতন্ত্র ছিল না। সুলতানই ছিলেন এই শাসনব্যবস্থায় প্রজাদের নিকট প্রভু এবং মালিক, তাদের ধন-প্রাণ স্বাধীনতার একছত্র অধিপতি, আইন ও ন্যায়ধর্মের অদ্বিতীয় প্রতিষ্ঠান স্বরূণ, নিজেরা অভ্রান্ত, দায়-দায়িত্বমুক্ত, দুর্নিবার– রাষ্ট্রে তিনিই ঈশ্বর।
কিন্তু সুলতানরা তত্ত্বগতভাবে সার্বভৌম এবং অসীম ক্ষমতার অধিকারী হলেও, ভারতীয় পরিবেশে বাস্তবক্ষেত্রে কতকগুলো সুনির্দিষ্ট ক্ষমতার সীমাবদ্ধতাকে তাঁরা মেনে নিয়েছিলেন। তাঁদের শাসনতান্ত্রিক কার্যাবলীকে প্রধানত তিনটি ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ রাখতেন, যথা- ‘জাহানগিরি’, ‘জাহান্দারি’ ও ‘জওবিৎ’ অর্থাৎ রাজ্যজয়, নববিজিত রাজ্যগুলোতে অধিকার সুসংহত করা এবং সামরিক বাহিনীকে সন্তুষ্ট রাখা। ক্ষুদ্র, সুশাসিত ও সমৃদ্ধ রাজ্যগঠনের স্থান তাঁদের রাজনৈতিক চিন্তায় ছিল না। একের পর এক রাজ্যজয়ই ছিল তাদের রাষ্ট্র ব্যবস্থার মূল বৈশিষ্ট্য। বলবনই একমাত্র রাষ্ট্রের সংহতিসাধনের কাজ প্রায় গণিতের সূত্রের মতো নির্ভুলভাবে তাঁর অভিপ্রায়ের বাস্তবরূপ দিয়েছিলেন, কিন্তু সাম্রাজ্যের পরিসর বৃদ্ধির কাজে আত্মনিয়োগ করতে পারেননি বলে, তাঁর দুঃখের শেষ ছিল না। আলাউদ্দিন তো বিশ্ববিজয়ের স্বপ্ন দেখতেন। মোহম্মদ-বিন-তুঘলক খোরাসান দখল করে অন্যদেশ জয় করার চেষ্টা করেছিলেন। স্বভাবতই যুদ্ধছিল দিল্লী সুলতানী রাষ্ট্রের জীবনীশক্তি। তাই সুলতানকে সামরিক শক্তির উপর নির্ভর করতে হত এবং এই শক্তিকে অস্বীকার করা সাধারণ প্রজার পক্ষে দূরের কথা, উলেমা সম্প্রদায়ের পক্ষেও তা অসম্ভব ছিল। শাসন ব্যবস্থা পরিচালনা ও রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও স্থায়িত্বের জন্য সুলতান দায়ী ছিলেন। দেশের আইন রক্ষা ও বিচার ব্যবস্থার দায়িত্বও তাঁর ওপর ছিল। দিল্লীর সুলতানদের সুবিচারের প্রতি দৃষ্টি ছিল অপরিসীম। এই বিচার ব্যবস্থায় আইনের চোখে সকলে সমান, এই নীতি বিবেচিত হত। সুলতান উপযুক্ত মন্ত্রণাদাতা, উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারী ও বিচারকদের নিযুক্ত করে সুষ্ঠু শাসনব্যবস্থা গড়ে তোলার চেষ্টা করতেন। তবে সুলতান ছিলেন একাধারে প্রধান সেনাপতি, প্রধান বিচারপতি এবং প্রধান আইন প্রণেতা। এই প্রশাসনিক ব্যবস্থায় সুলতান ছিলেন সকলের শীর্ষে। তাঁর অধীনে প্রজারা বসবাস করতেন। প্রকৃতপক্ষে দিল্লীর সুলতানী পোপ ও সীজারের সমন্নয়ে গড়ে ওঠেছিল।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন