ট্রুম্যান নীতি ও মার্শাল পরিকল্পনা:
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্ব রাজনীতিতে একটি নতুন যুগের সূচনা হয়, যা শীতল যুদ্ধ নামে পরিচিত। এই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের দুটি গুরুত্বপূর্ণ নীতি – ট্রুম্যান নীতি এবং মার্শাল পরিকল্পনা – বিশ্বব্যবস্থাকে গড়ে তোলে। এই নীতিগুলো কেবল কমিউনিজমের বিস্তার রোধ করেনি, বরং ইউরোপের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে অভূতপূর্ব ভূমিকা পালন করে।
ট্রুম্যান নীতি :
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্বরাজনীতিতে এক নতুন দ্বন্দ্বের সূচনা হয় – পুঁজিবাদ বনাম সাম্যবাদ। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে সোভিয়েত প্রভাব দ্রুত বিস্তার লাভ করছিল, যা পশ্চিমা শক্তিগুলির জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এই প্রেক্ষাপটেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট হ্যারি এস. ট্রুম্যান ১৯৪৭ সালের ১২ মার্চ মার্কিন কংগ্রেসে এক ঐতিহাসিক নীতি ঘোষণা করেন, যা ইতিহাসে ‘ট্রুম্যান নীতি’ নামে পরিচিত।
ঘোষণার পটভূমি:
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে পূর্ব ইউরোপে সোভিয়েত প্রভাব দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছিল। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিসৌরি অঙ্গরাজ্যের ফালটন শহরে বক্তৃতা দিয়ে এই পরিস্থিতিকে “আয়রন কার্টেন” নামে অভিহিত করেন এবং সাম্যবাদের প্রসার রোধে যুক্তরাষ্ট্র-ব্রিটেনের যৌথ উদ্যোগের আহ্বান জানান। অন্যদিকে মার্কিন কূটনীতিক জর্জ এফ. কেন্নান তার ‘বেষ্টনী নীতি’ (Containment Policy) প্রস্তাব করে জানান, সরাসরি সংঘাতে না গিয়ে সোভিয়েত প্রভাবকে সীমাবদ্ধ রাখতে হবে। এই দুই ভাবনা ট্রুম্যান নীতির ভিত্তি গঠন করে।
নীতির মূল বক্তব্য:
ট্রুম্যান ঘোষণা করেন, পৃথিবীর যেকোনো স্বাধীন জনগণ যদি সশস্ত্র সংখ্যালঘু বা বাইরের শক্তির প্রভাব প্রতিরোধে সচেষ্ট হয়, তবে যুক্তরাষ্ট্র তাদের রাজনৈতিক, সামরিক ও অর্থনৈতিক সহায়তা প্রদান করবে। এখানে ‘সশস্ত্র সংখ্যালঘু’ বলতে তিনি সাম্যবাদী বিদ্রোহীদের এবং ‘বাইরের শক্তি’ বলতে সোভিয়েত রাশিয়াকে বুঝিয়েছিলেন।
উদ্দেশ্য:
ট্রুম্যান নীতির মূল লক্ষ্য ছিল দুইটি—
- রাজনৈতিক লক্ষ্য – ইউরোপে সোভিয়েত প্রভাব প্রতিহত করে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে এক পুঁজিবাদী জোট গঠন।
- অর্থনৈতিক লক্ষ্য – আর্থিক সহায়তার মাধ্যমে অস্ত্র ও শিল্পজাত দ্রব্য বিক্রি করে আমেরিকার আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সম্প্রসারণ।
কার্যকরী পদক্ষেপ ও ফলাফল:
- তুরস্ক – সোভিয়েত চাপ থেকে মুক্ত রাখতে তুরস্ককে কয়েক শত মিলিয়ন ডলার আর্থিক সহায়তা দেয়া হয়।
- গ্রিস – সাম্যবাদী বিদ্রোহ দমন ও রাজতন্ত্রী সরকারকে শক্তিশালী করতে ৪০০ মিলিয়ন ডলার সহায়তা প্রদান করা হয়।
- ইরান – সোভিয়েত প্রভাব দূর করতে সামরিক ও বেসামরিক চুক্তি সম্পাদন, যা ইরানের তেল সম্পদে মার্কিন স্বার্থ রক্ষায় সহায়ক হয়।
আন্তর্জাতিক প্রভাব:
ট্রুম্যান নীতি ছিল ঠান্ডা লড়াইয়ের আনুষ্ঠানিক সূচনা। এর ফলে বিশ্ব দুই শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়ে—সোভিয়েত নেতৃত্বাধীন সাম্যবাদী ব্লক এবং মার্কিন নেতৃত্বাধীন পুঁজিবাদী ব্লক। দীর্ঘ চার দশক ধরে এই প্রতিদ্বন্দ্বিতা আন্তর্জাতিক সম্পর্কের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে থাকে।
মার্শাল পরিকল্প:
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল। খাদ্যাভাব, বেকারত্ব, অর্থনৈতিক সংকট—সব মিলিয়ে মহাদেশটি বিপর্যস্ত। এই পরিস্থিতিতে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জর্জ সি. মার্শাল ১৯৪৭ সালের ৫ জুন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে এক ঐতিহাসিক বক্তৃতা দেন, যা ইতিহাসে মার্শাল পরিকল্পনা বা মার্শাল এইড নামে পরিচিত।
মূল বক্তব্য:
মার্শাল ইউরোপের সব যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে মার্কিন অর্থসাহায্যের আহ্বান জানান। তাঁর মতে, ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও বেকারত্ব দূর করে মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে আমেরিকা অর্থ দেবে। তবে সাহায্যপ্রাপ্ত দেশকে নিজেদের অর্থনীতিকে স্বয়ম্ভর করতে হবে এবং এই অর্থ সমাজতান্ত্রিক পরিকল্পনা অনুযায়ী ব্যবহার করা যাবে না।
পটভূমি:
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধোত্তর বিশ্বে সোভিয়েত প্রভাব ঠেকাতে ‘ট্রুম্যান নীতি’ ঘোষণা করেছিল। সেই নীতিকে আরও কার্যকর ও সুসংগঠিতভাবে বাস্তবায়নের জন্য আনা হয় মার্শাল পরিকল্পনা।
উদ্দেশ্য:
মার্শাল পরিকল্পনার প্রধান লক্ষ্যগুলি ছিল—
- ইউরোপের যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশগুলোকে অর্থসাহায্য দিয়ে সোভিয়েত প্রভাবমুক্ত রাখা।
- পশ্চিম ইউরোপের অর্থনীতি শক্তিশালী করে একটি আন্তর্জাতিক বাজার গড়ে তোলা।
- সাহায্যপ্রাপ্ত দেশগুলোকে মার্কিন নীতির প্রতি আস্থাশীল করা এবং মার্কিন জোটকে শক্তিশালী করা।
- অর্থনৈতিক সাহায্যের মাধ্যমে এই দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক নীতি নির্ধারণে মার্কিন প্রভাব বিস্তার করা।
গুরুত্ব ও ফলাফল:
- আর্থিক পুনরুজ্জীবন – ১৭টি ইউরোপীয় দেশ এই পরিকল্পনা গ্রহণ করে তিন বছরে প্রায় ১২.৫ বিলিয়ন ডলার সহায়তা পায়। ব্রিটেন, ফ্রান্স ও পশ্চিম জার্মানি অর্থনৈতিক স্বয়ম্ভরতা ফিরে পায়; শিল্প উৎপাদন বৃদ্ধি পায় প্রায় ২৫% এবং কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি পায় প্রায় ১০%।
- পুঁজিবাদী ব্লকের শক্তিবৃদ্ধি – গণতান্ত্রিক দেশগুলো সোভিয়েত শিবির ছেড়ে মার্কিন নেতৃত্বাধীন পুঁজিবাদী জোটে যোগ দেয়, যা ঠান্ডা লড়াইয়ের উত্তেজনা বাড়ায়।
- কমিউনিস্ট প্রভাব হ্রাস – পশ্চিম ইউরোপের অনেক দেশে নির্বাচনে কমিউনিস্ট ও সমাজতান্ত্রিক দলগুলির পরাজয় ঘটে।
- চেকোশ্লোভাকিয়ার রাজনৈতিক সংকট – চেকোশ্লোভাকিয়া মার্শাল পরিকল্পনার প্রতি আগ্রহ দেখালে সোভিয়েত নেতৃত্বের নির্দেশে কমিউনিস্টরা সেখানে জোরপূর্বক ক্ষমতা দখল করে, যার ফলে দেশটি কমিউনিস্ট শাসনে চলে যায়।
উপসংহার : আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের ঔদ্ধত্যপূর্ণ মনোভাব আর সোভিয়েত ইউনিয়নের তাকে চ্যালেঞ্জ জানানোর মানসিকতা বিশ্বরাজনীতিকে এক জটিল আবর্তে নিক্ষেপ করে। তবুও মার্শাল পরিকল্পনা ও ট্রুম্যান নীতি তার উদ্দেশ্যপূরণে অনেকটা সফল হয়েছিল বলা চলে। এ প্রসঙ্গে ফ্রিডম্যান বলেছেন—১৯৫২ খ্রিস্টাব্দের জুনে যখন মার্শাল প্ল্যান কর্মসূচির অবসান ঘটলো ততদিনে তা প্রত্যাশা মতোই সাফল্য অর্জন করেছে।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন