ঠান্ডা লড়াই:
১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবসানের পর ভাবদর্শগত দিক থেকে সমগ্র পৃথিবী দুটি শক্তি শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়ে। একদিকে ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন গণতান্ত্রিক বা ধনতান্ত্রিক রাষ্ট্রজোট। অন্যদিকে ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বা সাম্যবাদী রাষ্ট্রজোট। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এই দুটি রাষ্ট্রজোট সমগ্র পৃথিবীতে নিজেদের সামরিক ও রাজনৈতিক প্রভাব প্রতিপত্তি বিস্তারের উদ্দেশ্যে যে লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয় তা ঠান্ডা লড়াই নামে খ্যাত। কারণ এই লড়াই কোনো সশস্ত্র লড়াই ছিল না। এটি ছিল এক ভাবাদর্শগত বা মতাদর্শগত লড়াই এবং তা কেবলমাত্র কূটনৈতিক স্তরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল।
ঠান্ডা লড়াই - এর তাত্ত্বিক ভিত্তি/ উদ্ভবের কারণ:-
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ধনতান্ত্রিক রাষ্ট্রজোট এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রজোটের মধ্যে সংগঠিত ঠান্ডা লড়াইয়ের উদ্ভব নিয়ে ঐতিহাসিকরা বিভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়েছেন, যা একত্রে তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা নামে পরিচিত। এগুলি হল-
[১] ঐতিহ্যবাহী বা রক্ষণশীল ব্যাখ্যা: এই মতবাদে বিশ্বাসীদের মতে, ঠান্ডা যুদ্ধ ছিল আদর্শগত বিরোধ এবং এর জন্য দায়ী ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের সাম্যবাদী আদর্শ ও সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ইউনস্টোন চার্চিল তাঁর 'The Second World War", হার্বাট ফিস তাঁর 'Churchill, Roosevelt and Stalin' এবং জর্জ কেন্নান তাঁর American Diplomacy” গ্রন্থে এবিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। তাদের মূল বক্তব্য হল, সোভিয়েত ইউনিয়নের উগ্র সম্প্রসারণ নীতির জন্য পৃথিবীতে আতঙ্ক ও নিরাপত্তাহীনতা সৃষ্টি হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সোভিয়েত ইউনিয়ন মিত্র শক্তির মতামত উপেক্ষা করে শক্তি প্রয়োগ করে পূর্ব ইউরোপের প্রায় সমস্ত রাষ্ট্রে কমিউনিস্ট সরকার প্রতিষ্ঠা করে। রক্ষনশীল ব্যাখাকাররা আরও বলেন, স্টালিন কমিনফর্ম গঠনের মাধ্যমে চেকোশ্লোভাকিয়ায় বামপন্থী অভ্যুত্থানে গোপনে মদত জুগিয়ে এবং ফ্রান্স, ইটালি ইত্যাদি রাষ্ট্রে কমিউনিস্ট দলকে জঙ্গি পথের দিশা দেখিয়ে পশ্চিমি দুনিয়ায় আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি করেন। এভাবেই রাশিয়া ঠান্ডা লড়াইয়ের প্রেক্ষাপট রচনা করে।
[২] সংশোধনকারী ব্যাখ্যা: এই মতের সমর্থকগণের (ব্যাখ্যাকাররা) মনে করেন - 'সোভিয়েত ইউনিয়নের সম্প্রসারনশীল নীতি নয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসী নীতি ঠান্ডা যুদ্ধের সূচনা ঘটিয়েছিল।' মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়নকে প্রতিহত করতে না পেরে নিজস্ব প্রভাবাধীন অঞ্চলের সম্প্রসারণ ঘটাতে শুরু করে ও ঠান্ডা যুদ্ধের সূচনাকে অবশ্যম্ভাবী করে তোলে। ওয়াল্টার লিপম্যান, ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত তাঁর 'The Cold War" গ্রন্থের জর্জ এফ. কেন্নান-এর সোভিয়েত বিরোধী বেষ্টনী তত্ত্বকে অগ্রাহ্য করেন এবং বলেন, "পূর্ব ইউরোপে সোভিয়েত সম্প্রসারণে বাধা দান করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ঠান্ডা লড়াই ডেকে আনে।"
[৩] বাস্তববাদী ব্যাখ্যা: একদল ঐতিহাসিক আদর্শগত এবং সংশোধনবাদী তত্ত্বের অবস্থান গ্রহণ করে ঠান্ডা লড়াইয়ের ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তারা মনে করেন যে, ঠান্ডা লড়াইয়ের জন্য দুই পক্ষই দায়ী ছিল অথবা কোনো পক্ষই দায়ী ছিল না। তাদের এই ব্যাখ্যা বাস্তববাদী ব্যাখ্যা নামে পরিচিত। এই মতের সমর্থক মরগ্যানথো দেখিয়েছেন জে, রুশ সম্প্রসারণ নীতি ও সাম্যবাদী আদর্শকে একই দৃষ্টিতে দেখে আমেরিকা অদূরদর্শিতার পরিচয় দেয়।
[৪] অর্থনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীতার ব্যাখ্যা: এই মতবাদের ব্যাখ্যাকাররা মনে করেন যে,'ঠান্ডা লড়াই ছিল প্রকৃতপক্ষে আমেরিকার অর্থনৈতিক সম্প্রসারণের অন্যতম দিক। গ্যাব্রিয়েল কলকো দেখিয়েছেন যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে আমেরিকার বিশ্বের শ্রেষ্ঠ অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয় এবং বিশ্ব অর্থনীতির প্রধান চালকের আসন লাভের চেষ্টা করে। এই লক্ষ্যে আমেরিকা তার বিদেশনীতির পরিবর্তন ঘটিয়ে মার্শল পরিকল্পনার মাধ্যমে বিভিন্ন দেশকে বিপুল পরিমাণে অর্থ সাহায্য দিয়ে যুদ্ধ বিধ্বস্ত ইউরোপে নিজেকে পরিত্রাতা হিসাবে তুলে ধরার উদ্যোগ নেয়। কিন্তু এক্ষেত্রে প্রধান বাধা ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন। এইজন্য সোভিয়েত ইউনিয়ন ও তার অনুগত রাষ্ট্রগুলির বিরুদ্ধে আমেরিকা একপ্রকার ক্রুসেড ঘোষণা করে। এর ফলেই ঠান্ডা লড়াইয়ের সূত্রপাত ঘটে।
বাস্তব এই, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ের আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি যে ঠান্ডা লড়াইয়ের উদ্ভবে অনুঘটকের কাজ করেছিল তা দ্বিধাহীনভাবে বলা যায়।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন